লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পৌর শহরের পির ফজলুল হক সড়কের দেনায়েতপুর এলাকায় অবস্থিত মসজিদ-ই-জামে আবদুল্লাহ। স্থানীয়ভাবে এটি ‘জিনের মসজিদ’ নামে খ্যাত। জনশ্রুতি আছে, প্রায় ১৩৫ বছর আগে এক রাতে শত শত জিন এই তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেছিল। যদিও এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবু এই কাহিনী মসজিদটিকে রহস্যময় করে তুলেছে।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১১০ ফুট এবং প্রস্থ ৭০ ফুট। এটিতে রয়েছে চারটি মিনার এবং তিনটি গম্বুজ। স্থানীয়দের মতে, মসজিদটি নির্মাণে কোনো রড ব্যবহার করা হয়নি; শুধু ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই স্থাপত্যশৈলীই জিনের নির্মাণের গল্পকে উসকে দিয়েছে। মসজিদের ভেতরে ও বারান্দায় একসঙ্গে প্রায় এক হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।
মসজিদের সামনে একটি বিশাল দিঘি অবস্থিত, যা এর সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। আজানের জন্য ব্যবহৃত একটি পুরোনো মিনার এখন পরিত্যক্ত। মসজিদের পশ্চিমে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা রয়েছে, যা এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক। ধর্মীয় উৎসব ও বিশেষ দিনগুলোতে মুসল্লি ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে মসজিদ প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়।
মাটি থেকে ১৩টি সিঁড়ি পেরিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। ভেতরে হালকা কারুকাজ দৃষ্টিনন্দন। মসজিদের একপাশের সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে, যেখানে সব সময় পানি থাকে। অনেকে এই পানিতে ওজু করেন, কেউ কেউ নিয়ত করে পান করেন বা বোতলে ভরে নেন। জানা যায়, এই স্থানটি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুল্লাহর ইবাদতখানা ছিল।
মসজিদের পাশে একটি কওমি মাদ্রাসা, মুসাফিরখানা এবং একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যা এলাকার শিক্ষা ও সামাজিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু।
১৮৮৮ সালে মাওলানা আবদুল্লাহ, যিনি একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন, ভারতে উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে একটি মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। গ্রামবাসীর সহযোগিতায় তিনি ভারত থেকে কারিগর এনে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর বংশধররা আজও মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন।
মসজিদের বর্তমান ইমাম মাওলানা লুৎফুর রহমান জানান, তাঁর বাবা ও দাদাও এই মসজিদে ইমামতি করেছেন। তিনি ১৪ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এটি জিনের মসজিদ নয়। মসজিদটি জনগণের অর্থায়নে এবং ভারতীয় কারিগরদের হাতে নির্মিত।” মাওলানা আবদুল্লাহও জীবদ্দশায় এই ধরনের জিজ্ঞাসার জবাবে একই কথা বলেছিলেন।
দেনায়েতপুরের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী আবু তাহের বলেন, “অবসর পেলেই আমরা এখানে ছুটে আসি। তবে মসজিদের নির্মাণ নিয়ে সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারেনি। জিনের গল্পে বিশ্বাস করেই অনেকে বিভিন্ন জেলা থেকে এটি দেখতে আসেন।”
রায়পুর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক মেয়র এবিএম জিলানী ও সদস্য সচিব সফিকুল আলম আলমাস বলেন, “মসজিদটি কে নির্মাণ করেছেন, তা এখনো রহস্য। তবে জিনের মসজিদ হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে।”
মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সদস্য মোতাচ্ছেম বিল্লাহ জানান, মসজিদের মূল নকশায় ১৬টি গম্বুজ ও সামনে একটি বারান্দার পরিকল্পনা ছিল। ব্যয়বহুল হওয়ায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বারান্দা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
‘জিনের মসজিদ’ নামে খ্যাত হলেও এটি মূলত মাওলানা আবদুল্লাহর স্বপ্ন ও জনগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল। ঐতিহাসিক এই মসজিদ শুধু ধর্মীয় স্থানই নয়, স্থাপত্যশৈলী ও স্থানীয় সংস্কৃতির একটি জীবন্ত নিদর্শন। রহস্য আর ইতিহাসের মিশেলে এটি প্রতিনিয়ত দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করছে।